নাজমা মোস্তফা
ইসলাম এ যাবত ধারাবাহিক খন্ডিত বিধানের পর একটি পূরিপূর্ণ বিধান নিয়েই আমাদের মাঝে নাজেল হয়েছে আজ থেকে চৌদ্দশত বছর আগে। তার প্রতিটি কাজ, তার প্রতিটি আচরণে পরিপূর্ণ আকারে আমাদের নবী মোহাম্মদ (সঃ) এর মাধ্যমে সুদীর্ঘ ২৩ টি বছরে সেই বিধান নেমে এসেছে থেমে থেমে, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় উদাহরণ হয়ে তা উজ্জ্বল জীবন্ত বাস্তবতার এক ব্যতিক্রমধর্মী দলিল এই কুরআন তার প্রমাণ হয়ে আছে।
কথা ছিল এই গ্রন্থটিকে আমাদের প্রধান সিলেবাস হিসাবে ধরে নিয়ে প্রতিটি জীবনের ছক আঁকবার। কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্যি কথাটি হলো আজো পুরাপুরিভাবে আমরা এই গ্রন্থটির সঠিক মূল্যায়ন করতে প্রকৃতপক্ষে অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছি। এবার আমরা পরবর্তীরা কিভাবে এর থেকে ক্রমশঃ দূরে চলে গেছি তা একটু খতিয়ে দেখলে এ গলদটুকুন খুব সহজেই আঁচ করতে পারবো। আমরা বর্তমান সময়কার বেশীরভাগ মানুষ এখন আর ঐ গ্রন্থ অনুসারে মোটেও চলার প্রয়োজন বোধ করি না। এটি আমাদের বেশীর ভাগের কাছে একটি পুথিগ্রন্থ যা আমরা পালন না করলেও দিনরাত জপে থাকি, আর কিছু না পারলেও এ কাজটি আমরা অনেকেই করি তৃপ্তিভরে।
প্র্রথম নাজেলকৃত কথা হিসাবে “পড়’ কথার নির্দেশ পালন না করলেও আমাদের কর্তাব্যক্তিরা এই আয়াতের বিরূদ্ধেই বেরিকেড তুলেছেন এই সেদিনও। যদিও নারীপুরূষ সবার উপরই এ কথাটি এসেছে তবুও এই নারীশিক্ষা উনাদের কাছে সেদিনও ছিল এক দারূণ অনাচার। রমজানের আগে শবেবরাত হিসাবে যা পালন করা হয় তাও বাস্তবে দেখা যায় প্রকারান্তরে কালের ধারায় গড়ে উঠা আরেক আচার, যার সাথে সঠিক ইসলামের কোন সামঞ্জস্যতা নেই। এটা এক অভিনব সংস্কৃতি বিশেষ করে ঢাকায় যেভাবে এদিন পালন করতে দেখেছি তা রমজানের চেয়ে অনেকের কাছে এ রাতের গুরুত্বই অধিক। ওখানে ঢাকাতে শবেবরাত এবং ঈদপর্ব বেশীর ভাগ জনতাই পালন করতে ব্যস্ত, রমজানের দিকে জনতার নজর বরং কম।
পার্শ্ববর্তী সমাজের কোন আচার কোন ফাঁকতালে এসে ঢুকে পড়েছে আমাদের এই প্রাচ্যদেশীয় এক ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা বলে। বাস্তবিকই অনেকে মনে করে থাকেন এ রাত নাকি স্রষ্টার নির্ধারিত সারা বছরের বিলি বন্টনের রাত। সত্যিই যদি তাই হয় তবে বলতে হবে আমাদের জনতা সারা রাত জেগে খুব কম পাওনাই অর্জন করেন। তার চেয়ে দেখা যায় ভিন জাতি গোষ্ঠীর যারা এ রাত ঘুমিয়েই কাটায় তারাই বরং দাওটা মারে ভালই। বাস্তবে ইসলামে প্রতিটি দিনরাতই পূণ্যের এখানে শনি মঙ্গলের কোন পার্থক্য নেই। সব দিনরাতই স্রষ্টার দিন, সব দিনরাতই সমান। একরাতে পার পাওয়ার এ হিসাব কালের ধারায় গড়ে উঠা আরেক অনাচার। ইসলামে শুধু একটি রাতের অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সেটি হলো শবে-কদর তার একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কারণেই, এই দিন পবিত্র গ্রন্থ আল-কুরআন প্রথম নাজেল হয়। তাই এই রাতটি সহস্র মাসের চেয়েও মূল্যবান বলে এই শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কোরআনে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যার সন্ধানে অনেকেই ইতেকাফ করে থাকেন। রমজানের শেষ দশ রাতের যে কোন একটি রাত এটি হতে পারে তাই অনেকেই এর সন্ধানে তৎপর থাকেন। কিন্তু সঠিক করে বলা নেই যে, এটা কোন রাত তবে এটা অবশ্যই সঠিক শেষ দশরাতের যে কোন একটি রাত।
এখন রমজান মাস চলছে। এই মাসটি নানা দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই। এরকম কোন ব্যবস্থা গোটা এই বিশ্বে আর দ্বিতীয় কোন জাতির মাঝে নেই। অবশ্যই এটি একটি অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা। কারণ এটা দেখানোর বা প্রদর্শন করার কোন বিষয় নয়। আল্লাহ এবং তার সৃষ্ট বান্দার মাঝে এক অলিখিত চুক্তি এই সময় কার্যকর থাকছে। চরম সংযমের মাধ্যমে সব ধরণের ভোগ থেকে আপন সত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রাখা, এবং ঠিক স্রষ্টার নির্দেশ মত তারই নিয়ম অনুসারে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এই সংযম একই ধারায় কার্যকর। এটার অর্থ এই নয় যে এ দলের ঘরে খাদ্য নেই, অগাধ প্রাচুর্য রেখেও এই সমাজের জনতারা বহুবিধ মঙ্গলার্থে স্রষ্টার নির্দেশে এই অসম্ভব সুন্দর ও ব্যতিক্রমী কাজটি করে চলেছেন। এর সুফল শারীরিক মানসিক আত্মিক বহুধা অর্জণে ভরা। একজন মুমিন তার হৃদয় মন আত্মায় আল্লাহকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে। শুধু তাকে খুশী করতেই তার আদেশ পালন করতে তারা কিছুই খায় না। যাকে জীবনেও দেখে নাই, শুধু শুনেছে আর বিশ^াসে বিঁধেছে, সেটি কি পরিমাণ দৃঢ়, ভাবেন – না হলে একজন রোজা করতেই পারবে না। এটি শুধু উপবাস করা নয়, এটি আত্মার পরিশুদ্ধির ব্যায়াম। একজন ক্ষুধার্তের ক্ষুধা কি হতে পারে সেটি কেউ না জানলেও জানে, একজন রোজাদার।
এটাই সঠিক ঈমান নির্ধারণের উত্তম মাধ্যম। কারণ একজনের ঈমান না থাকলে পৃথিবীর কোন শক্তি নেই তাকে এই কাজ করায়। তা ছাড়া সে যে কোন জিনিস যে কোন মুহূর্তে লুকিয়ে খেয়েও ফেলতে পারে বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাও হয়তো কেউ ধরতেই পারবেন না। কিন্তু এতো কিছুর পরও যে লোকেরা খাচেছ না, সেই বিশ্বাসের মূল্য কত? এবার পবিত্র গ্রন্থ থেকে দু একটি আয়াত এখানে প্রয়োজনে আনছি।
“(এ রমজান বিধিবদ্ধ হচেছ) নির্দিষ্ট সংখ্যক দিনের জন্য। কিন্তু তোমাদের মধ্যে যে কেউ অসুস্থ অথবা সফরে আছে সে সেইসংখ্যক (অন্য দিনগুলিতে পরে স্বাভাবিক অবস্থায়) রোজা রাখবে। আর যারা (বার্ধক্য, দীর্ঘস্থায়ী অসুখ, সারা বছর অবিরত ভ্রমন, গর্ভাবস্থা) এ অতি কষ্টসাধ্য বোধ করে (তাদের জন্য) প্রতিবিধান হলো একজন মিসকিনকে (সমান সংখ্যক দিনের জন্য) খাওয়ানো (বা রোজা ভাঙ্গার দিনগুলোর সমান সংখ্যক নিঃস্বকে একদিনের জন্য খাওয়ানো) কিন্তু যে কেউ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ভালো কাজ করে (যেমন মাসের শেষ দিকে ঈদের আনন্দ দানের জন্য ফিতরা আদায় করে) সেটি তার জন্য ভালো। আর যদি তোমরা (বিশেষ কষ্ট সহ্য করেও) রোজা রাখো তবে তোমাদের জন্য অতি উত্তম,—যদি তোমরা জানতে (রোজার মধ্যে আত্মসংযম, নিয়মানুবর্তিতা, ধর্মভীরুতা, ও সদা সতর্কতা অভ্যাসের মাধ্যমে চরিত্র গঠনের কতো না ভালো নিহিত আছে)” (সুরা বাকারাহ এর ১৮৪ আয়াত)।
“রমজান মাস এ মাসে কুরআন নাজেল (শুরু) হয়েছিল, মানব গোষ্ঠীর পথপ্রদর্শক হিসাবে, আর (পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর সর্বোত্তম জ্ঞানভান্ডার সহ ৯৮:৩) পথনির্দেশের স্পষ্ট প্রমাণরূপে, আর ফুরকান (অর্থাৎ ভালো মন্দ ও ন্যায় অন্যায় ভেদকারী গ্রন্থ)। কাজেই তোমাদের মেধ্যে যে কেউ (এই রমজান) মাসটির দেখা পাবে সে যেন এতে রোজা রাখে (এবং পানাহার, কামাচার, পাপাচার, পরিহারের দ্বারা সংযম সাধনার ও আত্মশুদ্ধির অভ্যাস করে)। আর যে অসুস্থ বা সফরে আছে সে সেই সংখ্যক অন্য দিনগুলোতে (রোজা রাখবে ২ঃ১৮৪) আল্লাহ তোমাদের জন্য সুবিধা (দিতে) চান, আর তিনি তোমাদের জন্য কষ্টকর অবস্থা চান না, আর (তিনি চান ) তোমরা যেনো (সারা মাসব্যাপী রোজা রেখে) এই সংখ্যা পূর্ণ করো। আর যাতে আল্লাহর মহিমা কীর্তন করো (তোমাদের আত্মসংযম ও আত্মশোধনের মাধ্যমে) যে পথনির্দেশ তিনি দিয়েছেন আর তোমরা যেন কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো (সুরা বাকারাহ এর ১৮৫আয়াত)।
রমজানের উপর নাজেলকৃত উপরের কথাগুলির সার সংগ্রহ করলে দেখতে পাই কটি কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো:
(১) অপারগতায় বা প্রয়োজনে রমজান পালনে ব্রতিক্রমী ব্যবস্থাও আছে।
(২) কষ্ট করে হলেও যদি সঠিক সময়ে রোজা করা যায় তবে বেশী ভাল।
(৩) জীবনে চলার পথে যখনই এর সাক্ষাৎ পাবে এর অনুসারীরা যেন তা পালন করে।
(৪) অসুস্থ বা সফরের রোজা পরে করে নিতে হবে। ছাড় দেয়া গেলেও কিন্তু মাফ নেই।
(৫) উপরের ব্যবস্থা কষ্টকর সন্দেহ নেই কিন্তু সুরা বাকারাহ এর ১৮৫ আয়াতেই প্রমাণ আল্লাহ তারপরও অযথা মানুষকে কষ্ট দিতে চান না।
(৬) যে স্বতঃ প্রণোদিত হয়ে ভাল কাজ করবে তা তার জন্য খুবই ভালো।
উপরের এই কয়টি কথা থেকে আমরা এটাই জানলাম যে রমজান এক ব্যতিক্রমী শিক্ষা মানব জীবনের জন্য এক আত্মিক প্রশিক্ষন ব্যবস্থা, শুধুই কষ্ট করানো এর উদ্দেশ্য নয়। মোটকথা এটার সঠিক উদ্দেশ্য মানুষকে সিরাতুল মোস্তাকিমের সঠিক শিক্ষা দেয়া, অন্য কিছু নয়। কিন্তু বাস্তবে আমরা আজ নানা দলে বিভক্ত। গোত্রে গোত্রে বিভক্ত হয়ে এক সত্যকে আমরা এক একজন এক একভাবে নিচিছ। আমাদের মাঝে দেখা যায় একটি বড় পরিবারের সদস্যরাও ক্রমে বিভক্ত হচ্ছেন সমঝোতার বিষয় নিয়ে, বিভেদ লেগে যায় এর বুঝার হেরফেরের জন্য। যদিও আমরা এক আল্লাহ ও এক রসুলের অনুসরনই করছি কিন্তু কার্যত আমরা কেন এত বিভক্ত আমাদের চিন্তায় চেতনায়। মনে হচ্ছে এর প্রধান কারণ আমরা মূল গ্রন্থে নেই বলেই। “নিঃসন্দেহ এটি (-শ্রেষ্ঠ স্বর্গীয় বাণী সম্বলিত এই কুরআন, ৫:৩, ৯৮:৩, সত্য মিথ্যা ও ন্যায় অন্যায়ের) সুমিমাংসাকারী বক্তব্য (১৭: ১২, ৮৯)। আর এটি কোন তামাশার জিনিস নয়”। (সুরা আত-ত্বারিক ১৩ ও ১৪ আয়াত)
সাম্প্রতিকমাসে প্রচারিত এই রমজানে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন পত্রিকার পাঠানো তথ্য থেকে কিছু সার তুলে ধরছি যা বর্তমান সময়ে মনে করা হয় ও পালন করা হয়।
(১) তারাবিহএর মাধ্যমে সারা কোরআন সমাপ্ত করা সুন্নত।
(২) এটা আমাদের ধর্মধারীদের বড় বিশ^াসের অংশ।
(৩) এই অপরিসীম কষ্ট করাটাই এই রমজান মাসের উদ্দেশ্য। মানুষকে কষ্ট করার শিক্ষা এটাতে স্পষ্ট।
(৪) বলা হয় তারাবিহ ছাড়া রোজা পরিপূর্ণ নয়। অনেককে বলতে শুনেছি অন্যথায় এটি শূণ্যে ঝুলে থাকে।
উপরে বর্ণিত ধারণার স¤পূর্ণটাই ভ্রান্তির উপর মানুষের মনগড়া কথা। কারণ এটা অবশ্যই কোন রসুলের সুন্নত নয়। আর রমজান উপলক্ষে এই বাড়তি কষ্ট উপরে বর্নিত কুরআন বিরুদ্ধ কথা। রমজান এক তৃপ্তির পাওনা, নিজেদের সৃষ্ট কষ্টের জন্য স্রষ্টাকে দোষ দেয়া সমিচীন নয়।
বর্তমান সময়কার প্রেক্ষাপটে বলতে হচেছ ২: ১৮৫ আয়াতের হিসাবে ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য কষ্টকর অবস্থা চান না’ বিরোধীতাই করছেন প্রকারান্তরে বেশীরভাগ জনতা। তারাবিহ এবাদতকে বর্তমান সময়ে এমনভাবে ব্যবসা কেন্দ্রিক করা হয়েছে যা এই কয়টি জেনারশেন আগেও এমনটি মোটেও ছিল না, তা অনেকেই বলতে পারবেন। শুনেছি অনেক আলেম বাবারাও এভাবে মসজিদভিত্তিক ফরজ নামাজের মতন গুরুত্ব দিয়ে এই কিছু আগেও ঠিক এভাবে পড়তেন না। তখন অনেকের যুক্তি সৌদিতেও হচেছ। কিন্তু অবশ্যই এটাও স্মরণ করার বিষয় যে, আমাদের প্রধান সিলেবাস মৌলিক নির্দেশনা এসেছে কুরআনে, সৌদি আমাদের আদর্শ নয়। সৌদ নামে কোন দেশে নবীও আসেন নাই, জাজিরাতুল আরবে নবীর জন্ম মৃত্যু চলা বলা। নবী অত্যন্ত সংযমী চরিত্রবান সুন্দর রুচির মানুষ ছিলেন। সত্যের সাথে মিথ্যে জুড়ে দেয়া আর মিথ্যার কোন বেসাতি তার ছিল না। কুরআনকে ডিঙ্গিয়ে তিনি কোন মনগড়া ব্যাখ্যা দেন নাই।
বেশীরভাগ পরিবারেই দেখা যাচেছ বৃদ্ধ বাবা এই বৃদ্ধাবস্থায়ই যার পর নাই কষ্ট করে রোজার সাথে খতম তারাবিহ, কেউ কেউ তারপরও এর ফাঁকে ফাঁকে শুনা যায় চিল্লাহ করছেন তিন দিনের, সাতদিনের (তাবলিগের অনুকরণে)। এই হলো বৃদ্ধ বাবার অবস্থা আর ঠিক তার পাশেই বেড়ে উঠা ছেলেটা বাবার এই অতিআচারের মাত্রায় বাড়াবাড়ি ভেবে পার্শ্ববর্তী সমাজ ব্যবস্থার প্রতিই আকৃষ্ট হচেছ, আস্তে আস্তে অনেক সন্তান দেখা যায় ধর্ম বিমূুখ হয়ে উঠে। সমাজের এই দুঃসহ অবস্থার মুখোমুখি আজকের বাস্তবতা। ছেলেমেয়ের হাতে অতিরিক্ত পড়ার চাপ, সামাজিকতার চাপ, বন্ধুত্বের হাতছানি তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না বাড়তি দুটি ঘন্টা এক নাগাড়ে এই নামে অপচয় করার। প্রকারান্তরে এখানে উভয়েই বাবা মা ও সন্তানেরা সবাই কম বেশী সত্যচ্যুতির শিকার। এটি যদি অবশ্য করণীয় হতোই তবে সেটি মাত্র দুটি শব্দেই আল্লাহ স্পষ্ট করে কুরআনে দিতেন। ‘তারাবিহ পড়’ বললেই শেষ হয়ে যেত। তাই মানুষ হয়ে খোদার উপর খোদকারী করা মনে হয় মানুষ জনমের জন্য সুখকর নয়। করোনা না আসলে এসব কথা বলার সুযোগও হয়তো হতো না। কিন্তু সত্য সন্ধানীকে সব সময় সত্যের পথেই হাটতে হবে। এ জন্যই বলা হয় সিরাতুল মোসতাকিমের রাস্তা সুক্ষ চুলচেরা বিশ্লেষনের সহজ সরল মধ্যপন্থা। চুলের চেয়েও চিকন ছুরির চেয়েও ধারালো।
বোখারীর বরাতে তারাবিহর জন্ম সংক্রান্ত দলিলে দেখা যায় এই এবাদতটিকে একটি বিদআত আকারে হাদিসেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। অনেকের কাছে কথাটি নতুন শোনা গেলেও হযরত ওমরের বরাত দিয়ে একটি হাদিসে এভাবে এসেছে। এর আগে তারাবিহর কোন ইতিহাস নেই। সত্যিকার গবেষনায় দেখা যায় এটা হযরত ওমরের কথার সূত্রে ছুন্নতের সম পর্যায়ে টেনে আনা হয়েছে। এটিও স্মরণ করার বিষয় নবীর সুন্নত কুরআন ডিঙ্গিয়ে হয় না। আর যদি ওমরের সুন্নত পালন করতে বলা হয়, তবে সবার চিন্তাশক্তিকে প্রসারিত করতে হবে। মোহাম্মদ (সঃ) কিভাবে রমজানে রোজা পালন করতেন এই প্রশ্নটি বিবি আয়েশাকে করা হলে তার জবাব ছিল এরকম যে, আপনারা কি কোরআন পড়েন না? আর তার অন্য জবাবটি ছিল এরকম যে, রমজানে এবং গয়র রমজানে তিনি তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন। এবং বাস্তবিকই বোখারী শরিফে যা বলা হয়েছে তাতে দেখা যায় এটি ওমরের বরাতে যে নামাজ পড়ার কথা আসে সেটিও শেষ রাতের নামাজই ছিল। প্রকৃত পক্ষে তাহাজ্জুদ, যা উনি জীবনের অনেক সময় পালন করেছেন হোক রমজানে অথবা রমজানহীন সময়েও। আর এই তাহাজ্জুদের নামাজ এক বাড়তি ব্যবস্থা তাদের জন্য যারা আল্লাহর অতিরিক্ত নৈকট্য চায়। আপনি চাইলে আপনার জন্যও। বনি ইসরাইল সুরার ৭৯ আয়াতে বলা হয় রাতের কিছু অংশ তাহাজ্জুদ তোমার জন্য, আদায় কর অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে। এতে তুমি মাকামে মাহমুদাতে (উচ্চ প্রশংসিত স্থানে) পৌছতে পারবে। আবার সুরা মোজাম্মেলের ৬ আয়াতে বলা হয়েছে নিশ্চয় এবাদতের জন্য রাত্রিতে উঠা প্রবৃত্তির উচ্চমার্গের সহায়ক ও স্পষ্ট উচ্চারণেরও অনুকুল। এর অর্থ সমাজের শত জটিলতাকে একপাশে ঠেলে তুমি নিশ্চিন্তে তোমার আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য এখানে সময় ব্যয় করতে পার। এটি নবীর জন্য অতিরিক্ত জমা।
এতে দেখা যায় আমরা যদি সঠিকভাবে কুরআন অনুসরণ করি এবং রমজানে অতিরিক্ত এবাদতের ইচছা করলে আমরা হাদিস অনুসারে হলেও সেই তাহাজ্জুদই পড়বো এটাই মোহাম্মদ (সঃ) কর্তৃক করণীয় বিধান। তবে তিনি সাধারণের জন্য তা বাধ্যতামূলক করার কোন নির্দেশ দেন নি। আর এই ভয়ে দেখা যায় ঐ হাদিস মোতাবেকই ঐ সময়ে প্রথম দুই / তিন দিন কিছু লোক জমায়েত হয়ে উনার পিছনে নামাজ পড়লেও চতুর্থ দিনে তিনি বের হন নি এই ভয়ে যে শেষে জনতারা এটাকে ফরজের সমান মূল্যায়ন করে তুলবে। এই ঘটনাটাও তাহাজ্জুদেরই ঘটনা। কিন্তু আমাদের অতি উৎসাহীরা এটাকে প্রায় ফরজের সমপর্যায়ে নিয়ে এসেছেন যা নবী মোহাম্মদের কৃত বিধানের বিপরীত সন্দেহ নেই। এখানে প্রকারান্তরে নবীর আশংকাই বাস্তব হয়েছে। মানুষরা এটাকে আজ ঐ পর্যায়েই নিয়ে এসেছে। সুরা বনি ইসরাইলের ৭৯ আয়াতে ও সুরা মোজাম্মেলের ৬ আয়াতে তাহাজ্জুদ নামাজের কথা এসেছে যেটি নবী তার বাড়তি অর্জনের কারণে প্রশান্তির জন্য খোদার নির্দেশ। সম্পূর্ণ অক্ষরজ্ঞানহীন একটি মানুষকে বাড়তি দক্ষতায় বলিষ্ট করতে এসব অর্জন নবীর জন্য অত্যন্ত জরুরী ছিল। আমরা যারা নবীর মত আল্লাহর নৈকট্য চাই তারা সানন্দে ওটি করতে পারি।
জীবনের চরম এক ক্রান্তিকাল আমরা কাটাচিছ। অতি আহার যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক ঠিক তেমনি অপুষ্টি, অনাচার অতি মিতাচার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। সুস্বাস্থ্য রক্ষা করতে হলে সব সময় একজন সদস্যতে পরিপূর্ণ ডায়েট খেতে হবে। ধর্মেও ঠিক একইভাবে আমাদেরকে সিরাতুল মোসতাকিমের পথে চলতেই বলা হয়েছে আমরা যদি শুধুই ঘোরা পথে চলি, খানাখন্দক চড়াই উৎরাই পার হয়ে চললেই আমাদের লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট না হবারই সম্ভাবনা অতিরিক্ত। তাই সিরাতুল মোস্তাকিমের রাস্তা অতিআচারে ও অনাচারে দুটোতেই ক্ষতিগ্রস্থ হবে সন্দেহ নেই। এর লেবেল নির্ধারণ করা আছে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থে। আর এই সাবধান বাণী এসেছে আজ থেকে চৌদ্দশত বছর আগে এবং এই সাবধান বাণী হিসাবে স্মরণ করার মত বক্তব্য শ্রেষ্ঠ গ্রন্থে অনেকই আছে।
সত্যিকার বিজ্ঞানময় অতীব সুন্দর বাস্তবধর্মী জীবন্ত প্রাণবন্ত এই ধর্মটিকে বর্তমান ব্যবসায়িক ধর্মীয় সমাজ ব্যবস্থা কুরআন থেকে অনেক দূরে নিয়ে এসেছে। বাস্তব ধারণা বিবর্জিত কাল্পনিক ধ্যান ধারণায় ধর্মটিকে সব দিক থেকে অতিভৌতিক এক কিম্ভুতকিমাকার রূপে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা হচেছ। সর্ব রোগের সংহার নিরোধকারীরা এক শ্রেণীর সদস্যরা সারা বছরই ওৎ পেতে থাকেন আনাচে কানাচে সর্বত্র তাদের প্রচারে, তারা এটিকে ব্যবসার অঙ্গ হিসাবে ধরে নিয়েছেন। শেষ রাতের এবাদতকে মানুষ ব্যবসায়ীক মোড়ক দেবার জন্য আগ রাতে টেনে এনেছে। যদি তারাবিহ পড়তেই হয় তবে নবীর মতই পড়–ন। শেষ রাতে মনের মাধুরী মিশিয়ে একান্তে আপনি আল্লাহর সান্নিধ্যে সত্য সাধনা করুন। আগ রাতে ঐ নামাজকে টেনে এনে হযরত ওমরের বরাতে হাদিস আকারে প্রচার করে তার মুখ নিসৃত কথাটি ছিল, তোমরা একটি ভালো বিদআত করছো। রসুলের হাদিস ছিল তোমরা বিদআত করবে না, যারা বিদআত করবে তারা জাহান্নামে যাবে। জানতে হবে বিদআত কি? ধর্মের নামে নতুন সংযোজনকে বলা হয় বিদআত। হযরত ওমরের বরাতে বলা হলেও তিনি ঐ বিদআতে সেদিনও যোগ দেন নাই। বোখারীর হাদিসে স্পষ্ট তিনি নিজে মানুষের ঐ জোটবদ্ধ নামাজে যোগ দেন নাই। আজ প্রথম রোজা চলছে বিধায় আমি আজকেই করোনার রাতে জেগে সেটি নতুন করে ব্লগের জন্য রেডী করছি। যদিও এ লেখাটি আজ থেকে ১০ / ১২ বছর আগে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দর্পণে এসেছিল।
ধর্মের পূর্ণতার পরও নানান ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ আমরা, এতে লাভের অঙ্কটা আমাদের জমছে কি? দেখা যাচেছ বৃদ্ধ বাবা নাকে মুখে ধর্ম ধর্ম করে আকন্ঠ আত্মাহুতি দিচেছন তার ঠিক পাশে বেড়ে উঠা সন্তানরা বাপের এসব কর্মকান্ডে ভ্রুকুঞ্চিত করে পশ্চিমা ধাচে বেড়ে উঠছে এবং ওদের দিকেই ঝুকে পড়ছে নানান কারণে। তার ধারণায় এই ব্যস্ত জীবনের ধারায় অতি আচার থেকে ওখানে মিতাচারের সন্ধান অনেক লোভনীয়। কিন্তু সঠিক সিরাতুল মোস্তাকিমের রাস্তায় চললে তার কখনোই বিভ্রান্ত হবার চান্স নেই। যুক্তি, বিজ্ঞান, ধর্ম, সত্য সবার একাত্মতা বরং প্রজন্মকে মুগ্ধ করতো, আকৃষ্ট করতো। একজন বৃদ্ধের এবাদত থেকে সঠিক বস্তুনিষ্ট এবাদত একজন যুবকের জন্য বেশী প্রয়োজন। বৃদ্ধ হলে সবাই কম বেশী এবাদত করেন মৃত্যুর বিভীষিকা চোখের সামনেই থাকে হয়তো বা। কিন্তু যদি একজন যুবক সঠিকভাবে সুনির্দিষ্ট কাজটি করতে পারে তবে সেটাই বড় ঈমানদারীর লক্ষণ, বড় পাওনা।
সিলেবাস শুধু বাড়ালেই লেখাপড়ার মানবৃদ্ধি হয় না বরং তাকে অর্থবহ বস্তুনিষ্ট ও বাস্তব জীবনমুখী করে তুলতে পারাই লেখাপড়ার উদ্দেশ্য। তাই অনেক সময় দেখা যায় অনেক লেখাপড়া করেও একজন একটা বিষয় নিয়ে কিছু লিখতে দিলে ব্যর্থ হন এটার কারণ লেখাপড়ার সাথে তার সঠিক একাত্মতা হয় নি, তাই। ধর্মটিও সে রকম যদি আমাদের আত্মায় অন্তরে না মিশে, প্রজন্মের নাক সিটকানো ভ্রুকুঞ্চনের শিকার হয় তবে, তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। শীঘ্রই এমন এক সময় আসবে যখন ধর্ম তার চলার গতি বাস্তবিকই হারিয়ে ফেলবে। আজ অনেকেই এটাকে স্থবির, জড় ও পঙ্গুত্বে আবদ্ধ করে রেখেছেন নানান কার্যকারণে।
ধর্মকে ব্যবসায়িক মোড়কে আবদ্ধ করতে এই কুরআনে নিষেধ করা হয়েছে। কোন আয়াত কেনাবেচার মূল্যে নির্ধারণ করতে হুশিয়ারী জানানো হয়েছে। ধর্ম কোন বিনিময়ের মাধ্যম হতে পারে না। এটা সবার আত্মার খোরাক, বেঁচে থাকার অবলম্বন। এটার কোন ব্যবসায়িক রূপ থাকতেই পারে না। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে সর্বত্রই দেখা যায় এই রমজানের মাসে এটা একটা ব্যবসায়িক লেবাসে আকন্ঠ আবৃত যা কুরআনীয় দৃষ্টিতে অবশ্যই গোলমেলে। এটা জনতার উপর চেপে দেয়া এক বাড়তি আচার, যেখানে আল্লাহ মানুষকে কষ্ট দিতে না চাইলেও আজ জনতা একটি বাড়তি আচারের শিকার।
অতিধার্মিকতার নামে বাড়াবাড়ি ও অর্ধামিকতা দুটোই সিরাতুল মোস্তাকিমের বৈরী অবস্থান আর এই দুই রাস্তা থেকে মুমিনকে বিশুদ্ধতার দিকে নিবদ্ধ থাকতেই কুরআনে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
(১) “তারা (এদিক ওদিক) দোল খাচেছ এর মাঝখানে—এদিকেও তারা নয়, ওদিকেও তারা নয়, আর যাকে আল্লাহ বিপথে চলতে দেন (হে মুহাম্মদ)! তুমি তার জন্য কখনো পথ পাবে না। (সুরা নিসার ১৪৩ আয়াত) (২) “তারা ব্যতীত যারা (আন্তরিকতার সাথে) তওবা করে ও শোধরায়, আর আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে, আর তাদের ধর্মকে আল্লাহর জন্য বিশুদ্ধ করে,—তারা তবে মুমিনদের সাথে, (থাকবে) আর শীঘ্রই আল্লাহ মুমিনদের দিচেছন এক বিরাট পুরষ্কার”। (সুরা নিসার ১৪৬ আয়াত)
প্রকৃত সত্য সুন্দর ধর্মটিকে সত্য ও সুন্দরভাবে পালন করতে এবং সুন্দরভাবে ভবিষ্যত প্রজন্মের হাতে আমানত স্বরূপ রেখে যেতে পারাই সঠিক মুমিনের কাজ। সে হিসাবে আমাদের বর্তমান ও আগামী প্রজন্মরা গবেষক মন মানসিকতা নিয়ে যেন ব্যতিক্রমধর্মী এই শান্তির ধর্ম ইসলামকে আত্মায় অন্তরে গ্রহণ করতে পারে এটাই হোক কঠিন যুগসন্ধিক্ষণের এ সময়কার আমাদের সঠিক দিক নির্দেশনা।
One source link can help you: https://www.ittefaq.com.bd/lifestyle/146746/
সুসংগ্রহ:
“আমাদের প্রভু! আর আমাদেরকে তোমার প্রতি মুসলিম (স¤পূর্ণ আত্মসমর্পিত) করে রেখো, আর আমাদের সন্তান সন্ততিদের থেকে তোমার প্রতি মুসলিম উম্মত (তথা চির অনুগত শিষ্য মন্ডলী বানিয়ে রেখো, ২: ১১২; ৩: ১৮) আর আমাদের উপাসনা প্রণালী আমাদের দেখিয়ে দাও, আর আমাদের তওবা কবুল করো; নিঃসন্দেহ তুমি নিজেই (বারবার) তওবা কবুলকারী, অসীম কৃপানিধান। (সুরা বাকারাহ এর ১২৮ আয়াত)
বি দ্রষ্টব্য: আশা করবো উদার মন নিয়ে বিবেকের বিশ্লেষনে সত্যকে সহজভাবে গ্রহণ করবেন। এ লেখা যেন কারো মনে কোন বিভক্তি রেখা না টানে। করোনার এ সংকট সময়ে সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন। সবার জন্য রমজান হোক আশায় ভরা জীবন সাধনা ও প্রাণবন্ত উদ্দীপনার জমা। প্রতিটি মুসলিম নারী পুরুষ এতেকাফ করবেন নিজের মত করে, শবেকদর আমাদের হাতে ধরা দেবে না, সেটি আমরা বলতে পারি না। আমরা আশরাফুল মকলুকাত। আমাদের জন্য আল্লাহর এত সাজগোজ আল্লাহর সে সাধনা সার্থক করুন। এ আশায় আমার এ বছরের প্রথম শুরুর রমজান। রাত তিনটা। ৪/২৪/২০২০।