মীর মশাররফ হোসেনের “গাজী মিঁয়ার বস্তানীর হারানো কবিতার অংশ:
কুষ্টিয়ার সন্তান , কুষ্টিয়ার লাহিড়ীপাড়াতে এক মুসলিম জমিদার পিতা মোয়াজ্জেম হোসেনের পরিবারে মীর মশাররফ হোসেন জন্ম গ্রহণ করেন। তার জীবনকাল (১৮৪৭-১৯১২), তার রচিত উপন্যাস, নাটক কবিতা, গান তৎকালীন সমাজ চিত্রের এক অনবদ্য দলীল। জমিদার দর্পণ, গাজী মিয়াঁর বস্তানী, বসন্তকুমারী নাটক,বেহুলার গীত, মুসলমানের বাংলা শিক্ষা, হযরত আমীর হামজার ধর্ম জীবনলাভ, এসব উল্লেখযোগ্য। ১৮৭৯ খৃঃ জানুয়ারী সংখ্যা “হাফেজ” পত্রিকায় মোশাররফ হোসন ‘উদাসীন পথিক’ নামে কবিতাটি ছিল “গাজী মিয়াঁর বস্তানীর চতুর্বিংশ নথির শেষ অংশ। “আমার জীবনী” গ্রন্থে বস্তানীর একবিংশ থেকে চতুর্বিংশ নথি প্রকাশ পেয়েছে, সেখানে এ কবিতাটি নেই। নয়ন চট্ট্রপাধ্যায় ডট কম সূত্রে মশাররফ রচনা সম্ভারের ৩৭৭ থেকে ৩৮২ পৃষ্ঠার পিডিএফ স্কেন কপি থেকে নেয়া। আমি কবিতার তিন ছন্দের লাইন সংক্ষেপ করে এক লাইনে সাজিয়েছি।
জানা যায় এটি এমন একটি সময় রচিত যখন রাজ্য হারা মুসলিমরা সাহস হারিয়ে জীবনের দেউলিয়াত্বের কঠিন সময় পার করেছেন। যার জন্য তাকে ছদ্মনামে কবিতাটি প্রকাশ করতে হয়। তারপরও তার পরবর্তী জীবনী গ্রন্থের মূল রচনা সম্ভার অনুপস্থিত। কারণ রাজ্যহারা মুসলিমরা সেদিন সব হারিয়েছে। অর্থ বিত্ত প্রভাব প্রতিপত্তি থেকে শুরু করে ইতিহাসও হারিয়েছিল বৃটিশ হিন্দুর কারসাজিতে। এর গভীর বাস্তবতা তার ‘উদাসীন পথিক’এর লেখাতে ফুটে উঠেছে। অসাম্প্রদায়িক মুসলিম সমাজের উদারতার সুযোগে কিভাবে হিন্দুরা মুসলমানদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়, তার সুক্ষ্ম চিত্র কবিতাটিতে খুব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
সবদিন মুসলিমদের মহানুভবতার বৈরী বর্ণবাদী হিন্দুরা: মুসলমানরা বাংলাভাষাসহ গোটা সমাজকে আদর্শ মানবতার বুলিতে আপলুত করে এক উদারবাদী সমাজের জন্মদান করে। কালে বিখ্যাত গবেষক পন্ডিত শ্রীযুক্ত ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন রায় বাহাদুর লিখেছেন, – বঙ্গ সাহিত্যকে একরুপ মুসলমানদের সৃষ্টি বললেও অত্যুক্তি হবে না। মুসলমান সমরাটগণ বহু ব্যয় করিয়া শাস্ত্রগুলিকে অনুবাদ করিয়াছিলেন। আবার দরিদ্র ভবঘুরে শ্রেণীর পুঁথি লেখক সাহিত্যিক আলাওল, মুসলিম মাগন ঠাকুর এদের মত মুসলমানদের পরিশ্রমেও বাংলা সাহিত্য গৌরবান্বিত হয়েছে। শ্রীযুক্ত দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেছেন, মুসলমানগণ ইরান, তুরান প্রভৃতি যে স্থান হতেই আসুক না কেন, এদেশে আসিয়া সম্পূর্ণ বাঙ্গালী হইয়া পড়ে। তাহারা হিন্দু প্রজা মন্ডলী বেষ্টিত হইয়া বাস করিতে থাকে। মসজিদের পাশে দেবমন্দিরের ঘন্টা বাজে, মহরম, শবেবরাত প্রভৃতির পাশে দুর্গ্যাৎসব, রাস, দোল উৎসব, চলতে থাকে। তিনি আরো বলেন, রামায়ন মহাভারতের মত মহান গ্রন্থগুলো সর্বপ্রথম অনুবাদ করেন রাজা হোসেনশাহ, পরগাল খাঁ এবং ছুটি খাঁ। আমরা জানি বাংলা কুরআন অনুবাদ করেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। যার জন্য মুসলিমরা তাকে ভাই বলেও সম্মোধন করে থাকেন। কিন্তু মুসলমানদের অবদানকে কোন সময়ই অপর পক্ষ সম্মানের সাথে দেখেছে তার নিদর্শন তুলনামূলকভাবে খুব কম বরং বারে বারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের হিন্দু সাহিত্যিকদের দ্বারা আক্রান্তই দেখা গেছে। তাদের বরণ্য সাহিত্যিকরাও মুসলিমদেরে যবন, ম্লেচ্ছ, পাতকী, পাষন্ড, দুরাত্মা, দুরাশা, নরপিশাচ, নরাধম, বানর, নেড়ে, দেড়ে, ধেড়ে, অজ্ঞান, অকৃতজ্ঞ বলেছেন। বঙ্কিমবাবু রাজসিংহে বাদশাহ আকবরের দাঁড়িতে যুবতী নারী দিয়ে ঝাড় মারিয়েছেন, উদার অসাম্প্রদায়িক আওরঙ্গজেবকে কপট সৃষ্টি হিসাবে প্রচার করা তাদের অনবদ্য কাজ ছিল, তার মুখে নারী দ্বারা লাত্থি মারান, মৃণালিনী গ্রন্থে বখতিয়ার খিলজীকে অরণ্যর অর্থে বানর বলেছেন। কবিতায় – “আসে আসুক না আরবী বানর, আসে আসুক না পারসী পামর।” ঈশ^রগুপ্তসহ এটি হিন্দু সাহিত্যিকদের অনবদ্য অবদান। এ অপবাদ থেকে কবি রবীন্দ্রনাথও বাদ যান নাই। বর্ণপ্রথায় আকন্ঠ নির্যাতনে ভঙ্গুর দিশেহারা ভারতবর্ষ ইসলামের মহানুভবতায় নির্যাতীত মানবাত্মা সেদিন বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শিখে, মুসলিম মননের কারণে তাদের অফুরান ঋণ থাকা সত্ত্বেও, তারা পারতোপক্ষে স্বীকার করেনা। বরং পরক্ষণেই তাদের সর্বস্ব লুটে নিতে বৃটিশকে তারা দেবদূত জ্ঞান করে। তাই রবীন্দ্রনাথ বৃটিশ বন্দনাতে গেয়ে উঠেন, জনগণ মন অধিনায়ক জয়হে, ভারত ভাগ্যবিধাতা যা আজো ভারতের জাতীয় সংগীত। আলোর দিশারী মুসলিমরা আজো তাদের চোখে পথের কাঁটা, কি ভারতে কি বাংলাদেশে। কিন্তু গাফেল অসাম্প্রদায়িক মুসলিমরা সেটি যেন আজো আঁচ করতে অপারগ। পাশের দেশের হিন্দুত্বের একটি প্রামাণ্য ভিডিও চিত্র।
KILLING FIELDS OF MUZAFFARNAGAR
“বর্তমান মুসলমান সমাজের একখানি চিত্র” যা রচনা করেন মীর মশাররফ হোসেন।
দ্বিতল ত্রিতল ঘর / খাড়া আছে ভিত্তিপর / সূর্কি চুন খসিয়া পড়েছে।
জানালা কপাট ভাঙ্গা, ভেঙ্গে পড়ে ইট রাঙ্গা / কত গাছ শিকড় ছাড়িছে।
চামচিকে আরশোলা / দিনকানা পেঁচাগুলা / গিরগিটি জেঠী করে বাস।
যাদের বাসের কথা / কুঁড়ে বেধে আছে তথা / দালানের এপাশ ওপাশ।
পেটে নাই অন্ন কণা / পরিয়াছে ছেঁড়া তেনা / ছেঁড়া কাঁথা কাহার সম্বল।
গরমে পরাণ যায় / ঠেকিয়া লজ্জার দায় / গায় দেয় দো-সূতী কম্বল।
কেহ মোট খেটে খায় / কেহ বোটে দাঁড় বায় / কেহ কাটে জঙ্গলের কাঠ।
কাঁটায় চিরিছে গাঁ / কুড়ালে কাটিছে পা / শিরে কাঠ, ফিরে সারা হাট।
সে হাট তাদের-ই ছিল / মহাজন বেঁচে নিল / এবে তারা কড়ার ভিখারী।
মোটা কঁচু, কাঁচা কলা / আলু ওলে ভরি জ¦ালা / বেচিতেছে বসিয়া দোধারী।
কাহার মাথায় বোঝা / ভারেতে হইল কুজা / সোজাভাবে চলিতে না পারে।
আজ অন্ন পেটে নাই / পাইবে দুই এক পাই / ক’ দিন চলিবে আর ধারে?
তামাক, আগুন, টিকে /জোগাইছে দোকানীকে / কেহ দেয় কলিয়া সাজিয়া।
মাসি বরাদ্দ আছে / তাতেই পরাণ বাঁচে / ছেলেমেয়ে পরিবার নিয়া।
এ হাট তাদেরি ছিল / ফাঁকি দিয়ে কেড়ে নিল / পুরাতন নায়েবের ভাই।
পৈত্রিক বসতবাড়ী / পুষ্করিনী গোলাবাড়ী / কিনিয়াছে তাহার যামাই।
প্রথমেতে ‘ছুচ’ হয়ে / পশে হিন্দু রয়ে রয়ে / মুসলমান জমিদার ঘরে।
ক্রমে চেপে বসে ঘাড়ে / সাধ্য নাই মাথা নাড়ে / ‘ফাল’ হয়ে ফাড়ে চেরে পরে।
বেঁড়ে বুড় বলদেরে / চোম্বা বলি সমাদরে / সদা মুখে যে আজ্ঞা হুজুর।
সম্মুখে দাঁড়িয়ে রয় / জোড় হাতে কথা কয় / তোষামোদে বড় বাহাদুর।।
গন্ডমুর্খ জমিদার / ফুলে হল ঢোলাকার / শুনিতেও ভাল লাগে কানে।
আগ পিছ নাহি চান / আহলাদেতে গলে যান / খাবি খান খুশীর তুফানে।
যদি বলি জল উচা / বলে হিন্দু তাই সাচা / প্রতিবাদ করে না কাহার।
বিদ্যাহীন, বুদ্ধিহীন, একেবারে অর্বাচীন / বাঙ্গালার প্রায় জমিদার।
অলসের দাস হয়ে / বিছানা বালিশ লয়ে / গড়াগড়ি যান দিনরাত।
মুখে দিতে দুটো ভাত / উঠে না উপরে হাত / দিন দিন হয় কুপোকাৎ।।
কাৎ হয়ে চিৎ হয়ে / হুকো টানে শুয়ে শুয়ে / মুখে করি সুবাসিত নল।
পরনিন্দা গ্লানি গীত /শুনে হন হরষিত / গায় গীত মোসাহেব দল।।
যাহারা দেশের মান / মানি মধ্যে মান্যমান / ছিল মান সম্ভ্রম প্রচুর।
তাঁদের তনয় যারা / আরদালি হরকরা / হইয়াছে মুটিয়া মজুর।
সদরালা পুত্র যিনি / কাছারিতে পাখা টানি / করিছেন দিন গুজরান।
কেহ লাল পাগ বেঁধে / চাপরাশ করি কাঁধে / পোড়া পেট জ¦ালায় হয়রান।
ডেপুটির পুত্র হয়ে / ডেপুটির বাক্স লয়ে / পালকির আগে আগে ধায়।
মুন্সেফের সন্তান / মারিয়া তামাকে টান / বাজারেতে টিকে বেঁচে খায়।
লক্ষপতি জমিদার / সন্তান সন্ততি তার / খেটে খায় অপরের বাড়ী।
কাজেতে করিলে হেলা / মার খায় দুই বেলা / জুতা লাত্থি খড়মের বাড়ী।
কটিতে কাঁপড় আটা / হাতেতে বাঁশের ঝাটা / যায় কাঁটা ফেলিতে পথের।
জিজ্ঞাস তাহার ঠাঁই / পরিচয় পাবে ভাই / সে যে পৌত্র কোন নবাবের।।
হইয়ে ঘোড়ার ঘাসী / ঘাস তোলে রাশি রাশি / খুরপিই খুন্তির সহায়।
পরিচয় জিজ্ঞাসিলে / সত্য কথা প্রকাশিলে / অবিশ^াস করিবে তাহায়।
খাঁ বাহাদুরের নাতি / ছিল কোটা বাড়ী হাতী / আরমাদার কিবা জমিদার।
গিয়াছে যা ছিল হায় / বার ভুতে লুটে খায় / এবে হইয়াছে খুন্তি সার।
ঐ যে ভিখারী যায় / ঝোলা ঘাড়ে ফিরে চায় / যাক ওরে জিজ্ঞাস কি বলে।
বাপ দাদা ধনবান / ছিল বড় মান্যমান / মাথা হেটে পুঁজিত সকলে।
তাহাদের বংশধর / ভিক্ষা মাঙ্গে ঘর ঘর / হাতে মালা কাঁধে ছালা ঝুলী।
গলায় তসবির দানা / দেরে বাবা! এক দানা / প্রাণ যায়, মুখে এই বুলী।
দেখ দিল্লী লক্ষ্নৌ গিয়ে / আছে ভস্মে আচ্ছা দিয়ে / কত মহামূল্য রতœধন।
শাহানশার বংশধর / পান বেঁচে করে ঘর / কোচয়ানী করে কোন জন।
নবাব কুলের কুল / বেচিতেছে ফলমূল / মাথায় করিয়া বোঝা বোঝা।
আম, জাম, নারিকেল / খরমুজা, পাকা বেল / ভারে দেহ হইয়াছে কুঁজা।
হাতেতে হীরার বালা / গলায় মোতির মালা / কানে ইয়ারিং ফিরোজার।
পায়ে সোনার মল / করিতেছে ঝলমল / কটিদেশে হেমচন্দ্রহার।
বেগম নবাবজাদী / বাইজীর হল বাঁদী / কেহ সাদী করে ভেড়ুয়ায়।
কেহ গুড়গুড়ি মাজে / কেহ বা তামাক সাজে / কেহ বাও করিছে পাখা।
বঙ্গের বুনেদী দল / গেছে সবে রসাতল / কেহ মরা কেহ আধমরা।
গেছে সবে হিন্দু ঘরে / কেহ বা তা দৃষ্টি করে / আরও মুখে বলে ভাল তারা।।
একবার মাথা তুলে / দেখ ভাই চক্ষু মেলে / মুসলমান কিসে হল সারা।
জমিদারী কোথায় গেল / সেনারুপা কি হইল / এত ঘর কিসে গেল মারা।।
চিরকাল হিন্দুগণ / করিতেছে নির্যাতন / তবু জ্ঞান হলনারে হায়।
নিতেছে সকল টেনে / তবু তারে নাহি চিনে / চক্ষে ধাঁ ধাঁ এমনই লাগায়।
দেখ যত হিন্দু ঘর / কিসে হল ধনেশ^র / খোঁজ দেখি কারণ ইহার।
প্রতি মুসলমান ঘরে / চাকুরীর সাজ পরে / সর্বনাশ করিল সবার।।
প্রকাশক “উদাসীন পথিক”
Shankaracharya Said Hindu Is Fake Religion – Dr Zakir Naik Islam Kay Mutalliq Galat Fahmiyaan
নাজমা মোস্তফা, ২৩ জুন ২০১৬ সাল।
Leave a Reply