বিশেষ দ্রষ্টব্য: উপরের লেখাটি ১৭মে ২০১৩ সালের লেখা। লেখাটি আমার দেশ অনলাইনে ছাপাও হয়েছিল, তারিখটি ছিল ১৯ মে ২০১৩ সাল। তবে কোনভাবে ব্লগে এর আগে মনে হলো দিয়েছিলাম, আজ আর খুঁজে না পেয়ে আবার নতুন করে আপলোড করে দিলাম।
সবার আগে বলছি ইলিয়াস আলীর কথা, তার অপরাধ দেশের জন্য মাথা উঁচু করেছিলেন। টিপাইমুখ বাঁধের নামে দেশে যে জাগরণ তৈরী করেছিলেন, ঐ অপরাধে তিনি গায়েব হয়ে যান। দেরীতে হলেও তার পাওনা তিনি পাবেন আশাকরি। নিউইয়র্ক থেকে আবু জাফর মাহমুদ সম্পাদকের লেখনীতে ২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল এটি বিবৃত হয়েছে যে, তাকে ও তার ড্রাইভারকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে ফরিদপুর গোয়ালন্দ ঘাটে। বিশাল বেশ্যা পল্লীর পেছনে নদীর দিকে নেমে যাওয়া ঢালুর ছাপরা ঘরে। ১৮ এপ্রিল ভোর সাড়ে চারটায় ঘাতকরা তাদের এ কাজ শেষ করে। পর পর বিদেশি দুটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা এ তথ্য বিলি করার পর সরেজমিনে এটি নিশ্চিত করেছে অন্য অনুসন্ধানীরা। তাদের হত্যা করতে নাইট্রিক এসিড ব্যবহার করা হয়েছে। অভিজ্ঞ ঘাতকরা সোজা পৌঁছে যায় তাদের গন্তব্য ঘাটে। ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে একজন তরতাজা উদ্দীপ্ত মানুষকে। কম সময়ে সেটি তারা সারতে পেরেছে তত্পরতার সঙ্গে। বাকি কিছু অপোড়া হাড়হাড্ডি ও কিছু দাগ-চিহ্ন ছুড়ে ফেলে দেয়া হয় পদ্মার মরা বুকে। ইলিয়াসের জন্য সিরিয়াস জাতি কিছুই করতে পারল না। একই ভাবে মারা যান হতভাগ্য ছেলে মেঘের মা-বাবা সাগর-রুনী নামের মানিকজোড়। আর এদিকে একজন সম্পাদক দ্বিতীয়বারের মতো এক মাসের বেশি সময় ধরে ধুঁকে ধুঁকে কারাগারে বন্দি। সবাই কি ওই অপেক্ষায় কাল কাটাচ্ছেন যে, ইলিয়াসের পরিণতিই হোক এক এক করে সমাজের সব সম্পাদক, রাজনীতিক ও সাংবাদিকের?
এমন না যে এসব কথার কথা। আন্তর্জাতিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবরণেও তা ধরা পড়ছে। বাংলাদেশের মানবাধিকারের প্রসঙ্গে ‘অধিকার’ নামের এক সংস্থা বস্তুনিষ্ঠ কাজের ক্ষেত্রে বেশ কৃতিত্বের দাবি রাখে। ৬ মে রাতের কোরআন পোড়ানো ও সেখানে আগুন দেয়ার যে বিবরণ ভিডিও ফুটেজেও আমরা দেখেছি দাপুটেদের উল্লাস আর বর্বরতা, এক্ষেত্রেও সরকার আবার নাকি সুরে উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানোর তার সেই স্বভাবসিদ্ধ পুরনো খেলায় বড় গলায় মেতে আছে। গোটা দেশের বেশিরভাগ মিডিয়া যেন করে চলেছে জনগণের নয়, সরকারের গোলামি। এত অনাচারের ভার সইতে না পেরে তাই প্রত্যক্ষদর্শীরা নিজের একার কম শক্তি নিয়েও সজোরে প্রতিবাদ করছে। আলজাজিরার ফুটেজে দেখি, এক বোবা আবদুল জলিল হাত-পা ঘুরিয়ে গলায় জবাইয়ের ইঙ্গিত বারবার করে দেখাচ্ছে, আর হেফাজতি সদস্যদের লাশ খোঁড়া জমিতে সদ্য পোঁতা বিশাল কবরগাহ দেখিয়ে দিচ্ছে। ধারণা ছিল, বোবা তো কাউকে কিছু বলবে না। তারপরও বোবা কথা যেটুকু বলেছে, ওতেই অনেক মৃত্যু রহস্য ঝরঝরে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। প্রতিটি মানুষ যদি চিন্তা করে এ ঝড় যদি তার নিজের ওপর দিয়ে যেত, তবে কেমন হতো? কেমন করে তারা সত্যকে গোপন করে যাচ্ছে; প্রকারান্তরে তারা বিধাতার বিরোধীপক্ষ, সব সুনীতির বিরোধিতা করছে;সম্প্রতি একটি নামের মা অন্তে প্রথম রেশটি শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না, তার পুরো নাম রেশমা। তার কারণ হচ্ছে, সে বেশ প্রশ্নের পাহাড় তৈরি করতে পেরেছে।
সবাই ধ্বংসযজ্ঞে মরছে, আর সে অমর হয়ে কাপড় পাল্টাচ্ছে, ম্যাচিং করছে; কারণ সে (ধারণা হয়) জানত যে, তাকে উদ্ধারে আসবে স্যাররাই—ভাইরা সেদিন পাত্তাও পাবে না। রেশমার চাকরির মেয়াদ একমাসও হয়নি, বিল্ডিং ধসের ১৭ দিন পর এক অবিস্মরণীয় উদগীরণ। তার আটকে পড়া ১৭ দিন ছিল মন্দের ভালো, কাটছিল শুকনো চার পিস কখনও শুনি চার প্যাক বিস্কুট আর পানিতে, কখনও শুনি শুকনো খাবারে। ম্যাচিং সালোয়ার-কামিজ যে করেই হোক, ঐ কংক্রিটের চাপা থেকেও উদ্ধারে সে সক্ষম হয়েছে। কেউ বলছে হেঁটে হেঁটে ড্রেস খুঁজে নিয়ে শুয়ে শুয়ে বড় কষ্ট করে পরেছে। তার মনোবল তারপরও মোটেও ভেঙে পড়েনি। সে ছিল ঝরঝরে ছিমছাম। কোনো অধামাস পার করা দুর্ভিক্ষের ছাপ পড়েনি তার অলৌকিক অ্যাডভেঞ্চারের ওই দেয়ালচাপা শরীরে। বারবার তাকে প্রসঙ্গ পাল্টে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিতে দেখা যায়। কখনও দালানে কখনও মসজিদ, তাতেই বাঁচে তার প্রাণ। গত শতকে রওশন এরশাদের সন্তান জন্মদানকালে বেশ চটকদার গল্পকথা শুনেছিলাম। ছিলাম ঢাকায়। মহিলারা বলেন, ‘বাবারে, রাজকীয় লোকের সন্তান মনে হয় লুকানোই থাকে। এই তো সেদিন দেখলাম কতই না বাহারি সাজে মহিলাকে মিডিয়াতে, স্কিনটাইট বডি, আজ আবার এ কী কথা শুনি মন্থরার মুখে! রেশমা তুমি কি ভাগ্যবতী না হতভাগী, জানি না। হয়তো নিকট ভবিষ্যতে তোমাকে খুন করা হবে, নয়তো বিদেশে পাড়ি দেবে তুমি, নয়তো বর্ডারে ধরা খাবে। আশা করি, এটি আগাম ধারণা করাতে দোষ হওয়ার কথা নয়।
রেশমাকে খোদ প্রধানমন্ত্রী তার গায়ের চাদর খুলে দেন;দেখা যায় রাতের চাদরে ঢাকা অন্ধকারে মানুষ মারলেও কিছু দয়ামায়া যে এখনও অবশিষ্ট আছে, তার প্রমাণ মনে হয় এসব। তবে সবার জন্য এটি নয়, শুধু সেভাবে লৌকিকতার সীমানা এড়িয়ে আসতে পারলে ওই রেশমার মতো একজনের জন্য শুধু। কীভাবে কী হলো বলতে অপারগ রেশমা। জানানো হচ্ছে গল্পের রেসের মা জ্ঞান হারিয়ে ছিল। এক লেখাতে পাই ১৭ দিন পর এক ইট কংক্রিটের ভেতর থেকে এক পোশাককন্যার আবির্ভাব। মাত্র ক’দিন আগে কাজে যোগদান করে, তার কাছে ছিল শুকনো খাবার (১৭ দিনের?)। কেউ বলছেন, মসজিদে পাওয়া গেছে, কেউ বলছেন দোতলায়। কথায় হরেক রকম—১, ২, ৩, ৪ রকমের ভার্সন পাওয়া গেছে। উদ্ধার পাওয়া রেশমা বাংলানিউজকে বলে ১৭ দিন পানি খেয়ে বেঁচেছে। নিচতলায় আটকালেও পরে নামাজঘরে চলে যায়। উপর থেকে উদ্ধারকর্মীদের পাঠানো বোতল দুটি কোনোভাবে সংগ্রহ করে। সেই থেকে প্রতিদিন অল্প অল্প পানে জীবন বাঁচে। দ্বিতীয় ভার্সন—এভাবে চলে ১৫ দিন আর বাকি থাকে মাত্র দু’দিন উপবাসে। তৃতীয় ভার্সন—মেয়েটির বরাতে মেজর মোয়াজ্জেম সাংবাদিকদের বলেন, ধসে পড়ার দিনও সে কোনো খাবার নিতে পারেনি। কেবল হাত ব্যাগে ছোট্ট চার প্যাক বিস্কুট ছিল। সেগুলোই অল্প অল্প করে খেয়েছে। উদ্ধারের পর অবাক-বিস্ময়ের শেষ ধাপে পৌঁছেন অনেকেই। কোনো ছাপই নেই তার পোশাকে অবয়বে; জামা-কাপড় অক্ষত। এ কোনো ভৌতিক ব্যাপার নয় তো? ওহ! জানা গেল উদ্ধারকর্মীর বরাতে, অনেক শুকনো খাবার পড়ে ছিল যে, তা-ও সে খেতে পারেনি। চতুর্থ ভার্সন—সবশেষে সাংবাদিকের ভাষ্যে রেশমা ২ বোতল পানিতে ও ৪ পিস বিস্কুটে এসে ঠেকেছে। ‘মায়াবিণীর একদম শেষের এক কথা, জাস্ট একটু পানি খাইছি, আর কিছু খাইনি’ দিয়ে কেটেছে ১৭ দিন। এ জটিল উদ্ভাবন কেমনে হলো? মনোয়ার নামের এক কিশোরের নজরে পড়ে প্রথম, ১৭ দিন পানি পান করা রেশমার পাইপ নাড়াচাড়া। সে বলেছিল ‘ভাই আমারে বাঁচান।’ শেষে কর্তাদের দেখে সে বলে, ‘স্যার, আমাকে বাঁচান।’ স্যারটি হচ্ছেন ওয়ারেন্ট অফিসার আবদুর রাজ্জাক। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগলেও মেজর মোয়াজ্জেমরা প্রশ্নহীন। অনেকের জেগে ওঠা প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ভেতরে ধুলোবালি ছিল না, তাই কাপড়-চোপড় পরিষ্কার। বাংলাদেশের ধুলো দেশবাসী কমবেশি নিশ্চয় জানেন। সাধারণ কয়তলা উপরে সাজানো-গোছানো ঘরেও থাকে ধুলোর আস্তরণ থরে-বিথরে। এক ঝাড়ে যায় না। তাকে পরিষ্কার করতে হলে রেশমাসুদ্ধ দশ ঝাড় দিতে হবে।
পরে আরও ভিন্ন ভার্সনের সন্ধান পাওয়া যায়। তা আরও ভয়ানক। একটি হচ্ছে অন্য মৃতদেহ থেকে কাপড় খুলে পরেছে রেশমা। কী ভয়ানক তার ১৭ দিনে না খাওয়া শরীরে এত ক্ষমতা, ধৈর্য, সাহস বা মৃতের কাপড় খুলে পরার গল্পের প্লট কে জোগাল—বিধাতা না সরকার? তারপর বলা হলো রানা প্লাজার দোকানের তাক থেকে কাপড় এনে অদল–বদল করে পরেছে রেশমা। বেশ মা, বেশ মা, তাহলে বেশ ভালোই ছিলে মা! মনে পড়ে আমার ছোটবেলায় এক ছোট বোন বড় আপামণির বিয়েতে আপুর কান্না দেখে বলেছিল, আপু কেন এত কাঁদছে? আমাকে এত কাপড়-গয়না দিলে আমি একরত্তিও কাঁদব না। রেশমার এ অবস্থায় কী বলা উচিত, বুদ্ধিতে আসছে না। তবে সে দেখি বলছে আর কখনও গার্মেন্টসে কাজ করবে না। এসব সত্যি হলে সে কাজ আর করল কোথায়, করল মঞ্চ নাটক। হাঁটা-চলার কোনো সুযোগ ছিল না। সে ১৭ দিন শুয়ে ছিল ৩-৪ ফুট দেয়ালচাপার গভীর অন্ধকারে। তাহলে সে কেমন করে মসজিদে গেল আর দোকান খুঁজে পেল? তার জামা কাপড় ছিঁড়ে যায়, পরনে কোনো কাপড় ছিল না। উদ্ধারের দিন টর্চলাইট দিয়ে কাপড় খুঁজে এনে পরে তারপর উদ্ধার হয়। নাটক বেশ জমেছে মনে হচ্ছে। সে এ চিন্তাও করেছে কেমন করে বের হবে। সে তো মেয়ে, ছেলে নয়! নাটকের ডায়ালগ একদম তুঙ্গে। এক রসিকজনা কর্নেল আরশাদের বরাতে বলেন, সে কাপড়ের মার্কেটে গিয়ে পড়ে, আর সেখান থেকে শুয়ে শুয়ে পরে নেয় পছন্দের কাপড়টি। সে নিশ্চয় পছন্দ করেই নেয়; বরং সঙ্গে মা–বোনদের জন্য আরও ক’টি নিতে পারত। ১৭ দিনের আধমরার এ ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা একদম নতুন; তাই কেমন করে কী বলতে হবে, কোনটা খাপে খাপে মিলবে, তা তার জানা ছিল না। তাই অনেকের কাছে কিছু বেখাপ্পা ঠেকছে। চার পিস বিস্কুট বা শুধু পানিতে বা দুই বোতল পানিতে এত ঝরঝরে থাকা যে কেউ টেস্ট করে নিতে পারেন আর সাত্ত্বিক মুসলিমরা এ পরীক্ষা দেন প্রতি বছরে একবার। একদিন ক’ঘণ্টার না খাওয়াতেই অনেকে খেই হারিয়ে ফেলেন, আর সে তো আধা রমজানেরও বেশি কাটিয়ে দিল সাহরি–ইফতারবিহীন; রাতের খাবারও অনুপস্থিত। তারপরও সতেজ থাকা! রেশমার ঈমানদারির সঙ্গে পৃথিবীর কোনো মানুষের এঁটে উঠবার কথা নয়। অলৌকিক ঈমানদারি ফুটে উঠেছে তার বিরল এ ক্যারিশম্যাটিক শরীরে।
তার কাটা চুল নাকি সে ইট দিয়ে কেটেছে। তারপরও নাদানরা কত কিছু লক্ষ করেছে! কেউ বলছে নখও একদানা লম্বা হলো না কেমনে—দাঁতও হলুদ হলো না, ঝকঝকে পরিষ্কার; একই অঙ্গে এত রূপ কেমনে আটকায়? সে মাঝে মাঝে হেসেছে। মনের কাছে না হেসে তার উপায়ও নেই! সবাইকে এমন বোকা বানাতে মে মাসই ধরা খেল, এপ্রিলে নয়। বাংলাদেশীরা এবার মে মাসের বোকা সাজল। তার সামনে অনেক মানুষ মারাও গেল, উদ্ধারও হলো, কিন্তু সে কেন ওই সময় আওয়াজ করল না? এর কোনো উত্তর তার জানা ছিল না। ফ্যাল ফ্যাল করে চাওয়া ছাড়া অন্য জবাব ছিল, ‘মরা’। ১৭ দিন গত হলে পর তার আওয়াজ নিঃশেষ না হয়ে বরং সেদিনের বলিষ্ঠ আওয়াজই পৌঁছে জনতার কানে। তা-ও সাধারণ আনোয়ার-মনোয়ার নয়, একদম মেজর মোয়াজ্জেম বা হর্তাকর্তারা সেখানে কী পাহারা দিচ্ছিলেন, ইট-পাথর নাকি রড-ধুলো? জীবন্ত মানুষ তো থাকার কথাও নয়, তখন কার্যত বেশি শ্রমিকেরই থাকার কথা। এ ধরনের শত বিষয় প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীতে মিথ্যাকে সত্য বানানোর মতো কঠিন কাজ আর দুটি নেই; বরং এক্ষেত্রে সত্যকে উদ্ঘাটন করা খুব সহজ কাজ। বাস্তবিকই সে হিসেবে বর্তমান সরকার অনেক কঠিন কাজ করছে। বিডিআর, সাগর রুনী, ইলিয়াস আলী, সুখরঞ্জন—এ ধরনের হরেক সত্যকে মিথ্যা করে সাজানোতে যে মেধা পরিশ্রম সরকারকে ব্যয় করতে হচ্ছে, তার তুলনা নেই। এটি প্রায় অসম্ভব কাজ সরকার করছে। সোনার পাথরবাটি আর কী!
রেশমার চোখে কোনো মলীনতা কারও চোখে ধরা পড়েনি। সেটি সবাই দেখেছে, ছবিতে ভিডিওতে সেটি খুবই সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এটি লুকানোর সাধ্য নেই। বোঝা যাচ্ছে, মরুর লু হাওয়া বা ধসের তাণ্ডব তার ওপর দিয়ে মোটেও যায়নি, বরং বলা চলে বয়ে গেছে বেহেশতের হিমেল হাওয়া। এপ্রিল-মে’র গরমে তার সিদ্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। মেজর জেনারেল সারোয়ার্দী সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে বলছেন, তার সঙ্গের তিন পোশাক শ্রমিককে আগেই উদ্ধার করা হয়—যারা ছিল মৃত। তা হলে সে কেমন করে জীবিত থেকেও উদ্ধার হতে এত সময় নিল? কোথায় ছিল সে, রানা প্লাজার দোকানে ড্রেস খুঁজতে, না অন্য কোথাও! এত তেজস্বী শক্তিধর, এত বড় ধসও তার সামনে কিছুই নয়, রেশমা কিন্তু কোথায় কাজ করত তা বলতে পারে না—আটকে যায়। স্মৃতি তার বিলুপ্ত নয় মোটেও। বাকি সবই মনে আছে—প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারে যান তাকে দেখতে, শুনেছি কে জানি বলল, সে নাকি দেখতে চেয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে! প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কী সম্পর্ক ছিল, জানি না। সহজভাবে সব অঙ্ক মিললে কোনো কথা ছিল না। কিন্তু অঙ্ক গোঁজামেলে হওয়ায় সবকিছুই যেন ঝাপসা লাগছে। অলৌকিক রেশমা শুধু একটি কথা বলছে, আল্লাহর ইচ্ছায়। উদ্ধার কাজে থাকেন জেনারেল সরোয়ার্দী। কী অসাধারণ এ অভিযান, যেন ১৯৬৯ সালের চন্দ্রাভিযানকেও হার মানাবে! জানলাম, তার অলৌকিক অভিযানের সম্মানে আবার নারায়ে তাকবিরও দেয়া হয়। কিন্তু বিধাতা মানুষের জন্য এসব টিটকারির জবাবে কিছু কথা বলে রেখেছেন। মেজর জেনারেল হর্তাকর্তারা এটি স্মরণ রাখবেন। সে সময় মিডিয়ার কেউ ছিল না। সেনা অফিসার রাজ্জাক বলেন, তিনি মিডিয়ার লোকেদের ভবনের উপরে নিয়ে যান আর এ ফাঁকে অলৌকিক অভূতপূর্ব এ কাণ্ড ঘটে যায়। সে ১৭ দিন পানি খেয়ে বেঁচে ছিল, আর পাশের লোকরা পানি না পেয়ে অনেক আগেই মরেছে এবং উদ্ধারও হয়েছে। সবই বিবেককে আহত করছে।
সবাই তার জন্য অতিমাত্রায় কাতর ও ব্যস্ত, কিন্তু সে হিসাবে রেশমা মোটেও ব্যস্ত বা ক্লান্ত নয়। একটি ছবিতে দেখি, সে তার নিজ হাত দিয়েই কিছু চেপে ধরেছে নাকের কাছটায়। বলা চলে, সে অনুপাতে সে বেশ উত্ফুল্ল, ছিমছাম, হৃষ্টপুষ্ট। বেশ নাদুসনুদুস রেশমা, হাঁটাচলাতেও ভালো অভ্যস্ত, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দূরে ঠেলে রাখলে। কেউবা বলছে একমাত্র গাঁজাখোর এ গল্প বিশ্বাস করবে আগে-পরে, আর বিবেকবানরা প্রথমে সহজ অঙ্ক হিসেবে ধরে নিলেও পরে হোঁচটে আটকাবেন। গোলক ধাঁধা নামের চক্করে দেখবেন ‘মাথা যে ঘোরে!’ মিডিয়ার সামনে আসতে প্রস্তুতির রেশ ধরে রেশমার বেশ সময় লাগে। সাংবাদিকদের দেয়া হয় নানা বিধিনিষেধ। অর্ধশত উপস্থিত হলেও প্রশ্ন করার সুযোগ পান অতি ভাগ্যবান তিনজন সিলেক্টেড সাংবাদিক। ১টা থেকে ৫টা পর্যন্ত অপেক্ষার পর তারা তার সুযোগ পান। হাঁটতে বসতে জাতি লাথিগুঁতো খেলেও রেশমার মর্যাদা কোথায় পৌঁছেছে বুঝতে কারও অসুবিধা হবে না! মেজররা একপায়ে দাঁড়া। মেজর মো. তৌহিদ–উজ–জামান কে কী প্রশ্ন করবেন, তার তালিকা তৈরি করেন। মেজর জামান বারবার সতর্ক করে দেন যে, একটির বেশি প্রশ্ন করা যাবে না। সাংবাদিকেদের মনেও প্রশ্ন, এত লাশের সারিতে এ মেয়েকে নিয়ে কেন এত বাড়াবাড়ি? আড়ালে–আবডালে সরিয়ে রাখার একটি প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে। কত ছেঁড়া, ল্যাংড়া–লুলা পড়ে রইল সারাদেশে, আর এ সুস্থ মেয়ে দিব্যি বিস্কুট–পানি খেয়ে আছে; তার জন্য এত আদিখ্যেতা করার কী অর্থ থাকতে পারে? মেজর তৌহিদ-উজ-জামান অনেক প্রশ্নের জবাবে বলেছেনও, এসব কিছু প্রশ্নের উত্তর সংবাদ সম্মেলনে দেয়া সম্ভব নয়। এটি ছিল বিপাকে পড়া জামান সাহেবের জবাব। এটি তিনি আলাদাভাবে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের জানাবেন, এটি জানে শুধু আইএসপিআর। প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় রেশমার মা-বাবা বা অন্য কাউকে দেখা যায়নি। তার আচরণে কখনোই তাকে কাতর বা ভীত মনে হয়নি। কিন্তু সেনা কর্মকর্তা ও চিকিত্সকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তার আচরণকে সামাল দিতে পেছন থেকে নার্স আইরিনকে তার ঘাড়ে চাপা সঙ্কেত দিয়ে তাকে সামাল দিতে হচ্ছে। যাবার সময় সে হাসিখুশিভাবে সাংবাদিকদের উদ্দেশে হাত নেড়ে দেখায়।
সুখ রঞ্জনের মুখের কথা ইউটিউবে সাক্ষীর বক্তব্য হিসেবে শুনে থাকবেন দেশের ভেতরের-বাইরের সচেতনরা; কারণ বিষয়টি বিশ্ব নাড়িয়ে দিয়েছে। ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে তাকে অপহরণ করে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন অপহরণ করে তাকে ভারত সীমান্তে ঠেলে দেয়। কারাগারে থেকেই তিনি তার আদ্যপান্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। ইংরেজি দৈনিক নিউএজ এক অনুসন্ধানী কাজে এটি উন্মোচন করতে সক্ষম হয়। এটি লিখে পাঠান ডেভিড বার্গম্যান। বালী ছিলেন দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর একজন সাক্ষী। আদালতে এসেছিলেন গত ৫ নভেম্বরে। পিরোজপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের এ সাক্ষী সত্য প্রকাশেই উত্সাহী ছিলেন, বিধায় সাক্ষীকে এ প্রক্রিয়ায় সরকার আস্ত গিলে ফেলে। আদালত চত্বর থেকে তাকে তুলে নিয়ে পুলিশের গাড়িতে করে ডিবির অফিসে নেয়া হয়। অপহরণ করে পার হয় বিএসএফের দোরগোড়ায়। ওরা খুব সহজে বাংলাদেশী মানুষকে মেরে ধরে গুলি করে হজম করতে পারে। গত ৩ এপ্রিল ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে দেশটির ফরেনার অ্যাক্ট ১৯৪৬এর অধীনে কলকাতার একটি আদালত বালীকে ১০৫ বা ১১০ দিনের কারাদণ্ড দেয়। সুখরঞ্জন বালীর ভাই বিশা বালীকে হত্যার অভিযোগে দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর ফাঁসির রায় হয়। এটি এমন এক রায়, যেটি মৃতের আপন ভাইও এ মিথ্যা সায় দিতে রাজি নয়। সেটি আমরা ইউটিউবেও দেখেছি। সেখানে তার আরও সদস্যদের একই বক্তব্য। তাই যত বিভেদের ফ্যাকড়া বিঁধেছে। বালী বলেন, অফিসের লোকজন পুলিশের পোশাকে ছিল, কিন্তু তাকে অপহরণ করে সাদা পোশাকের লোক। দুটি ক্ষেত্রেই ইলিয়াস ও বালীর অপহরণে এক ধরনের দাগচিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে। বিচারের নামে প্রহসন আর কত হবে? বাংলাদেশে তাকে মারার হুমকিও দেয়া হয়—এভাবে যে, সাইদীকে ফাঁসি দেয়া হবে এবং তাকে হত্যা করা হবে।
দেশের আইন এমন পর্যায়ে গেছে যে বাদীআসামি দুজনাই ফাঁসিতে ঝুলবেন; শুধু বিচারক বেঁচে রইবেন তার নষ্টের প্রতাপী দলবল নিয়ে। নিউইয়র্কভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নিজস্ব ওয়েবসাইটে পোস্ট করা এক প্রতিবেদনে খবরটি প্রকাশিত হয় ১৬ মে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের একজন সাক্ষীকে এভাবে অপহরণ করার ঘটনা মারাত্মক উদ্বেগের বিষয়। এ পুরো বিচার প্রক্রিয়া, এর বিচারকরা এবং বাংলাদেশ সরকারের বিষয়ে আমাদের মারাত্মকভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।’ এক খবরে দেখি তাকে পুশব্যাকের চেষ্টা করা হচ্ছে, আর আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ সবাই আতঙ্কে আছে। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) ভারতীয় অফিসের সঙ্গে সুখরঞ্জন বালীর সাক্ষাত্ হওয়ার আগে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো উচিত হবে না—এ খবরেও ওই সংস্থা আতঙ্কে আছে। বিবিসির বাংলা অনলাইন ভার্সনেও ট্রাইব্যুনাল চত্বর থেকে নিখোঁজ হওয়া সুখরঞ্জন আলোচনায় এসেছেন। বালীই উদ্যোগী হয়ে নিজেকে ওপেন করেন। এর জন্য সেখানকার একজন জেল কর্মকর্তা সহযোগিতা দেন। যার খেসারত হিসাবে শাস্তির গুরুদণ্ড এবার ওই জেল কর্মকর্তাকেও গুনতে হবে। তার ব্যাপারেও হিউম্যান রাইটসের এগিয়ে যাওয়া উচিত।
বর্তমানে শাসকপক্ষের কিছু বৈশিষ্ট্য—এরা সব হ্যাঁ–কে না করতে পারে, আবার সব না–কে হ্যাঁ করতে পারে। যেমন প্রধানমন্ত্রীর বায়না বিরোধী নেত্রী তাকে গ্রেনেডে মারতে চান। কিন্তু তিনি সবসময়ই ছাত্রনেতাসহ দলে–বলে পুলিশি দেশের হুমকিতে ওই গ্রেনেড নিয়ে দেশময় কর্তৃত্ব করে বেড়াচ্ছেন। আর একটি কথা বহু আগে থেকেই শোনা যায়, সেটি হচ্ছে লাশের রাজনীতি। সম্প্রতি (২০১৩ সালে) লাশ আর লাশনীতিই শক্তিধর জীবনের এক অমোঘ নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রামুতে হিন্দুমন্দিরে হামলা—শক্তিধররা সবখানেই এ ধ্বংস নীতিতে জড়িত। সুখরঞ্জন বালী হিন্দু না মুসলিম, সেটি বড় হয়ে দেখা দেয়নি। সুখরঞ্জন বালী এক সত্যনিষ্ঠ দরিদ্র মানুষ। বড় বড় কর্তাদের কাছে তিনি কিছুই নন। কিন্তু তার অন্তরে একটি সত্ মানুষ যে ঘুমিয়ে আছে, তা তাকে কলকাতার কারাগারে রাখলেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। কাল একজন বলছিলেন, সুখরঞ্জন বালী ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। তারপরও তিনি সত্যের কারণে শক্ত থাকতে পেরেছেন। এটি অনেক সাহসের কথা। বিএসএফের কর্মকর্তারা তাকে নির্যাতন করে। সে হিন্দু বলে কি তাকে সেখানে পাঠানো হলো—এর যুক্তি কী? চার ব্লগারকে আমেরিকা পাঠানোর পাঁয়তারা চলছে। সরকার কেন সুখরঞ্জনকেও আমেরিকা পাঠাল না? সেটি ভাবছি। ইলিয়াস আলীর অবস্থা আরও করুণ। তাকেও আমেরিকা না পাঠিয়ে পরপারে পাঠিয়ে দেয়া হলো কেন? সরকার নিজেই বলছে আতঙ্কে আছে। তত্ত্বাবধায়ক এলে নাকি ফের কারাগারে ঢুকতে হবে। সরকারের কারাগারে ঢোকানোর অনেক রসদ এযাবত্ সরকার নিজের উদ্যোগে তৈরি করে রেখেছে। কারাগারে যাওয়ার জন্য আর তত্ত্বাবধায়কের অপেক্ষা করতে হবে না। তাকে এমনিতেই ঢোকানো যাবে।
চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। তারপরও বলি। যারাই সত্য উন্মোচন করছেন, তারা পুণ্যের কাজ করছেন, যা তাকে ব্যতিক্রমী অর্জনধারী করে তুলবে। সুখরঞ্জন বালীরা ওই দলে ঢুকছেন। আর যারা অপরাধ ঢেকে রাখছেন, তারাও কর্মকর্তার সমান পাপের অধিকারী হয়ে থাকবেন। ঐশী নির্দেশ তাই জানান দিচ্ছে। ‘আর সত্যকে তোমরা মিথ্যার পোশাক পরিয়ো না বা সত্যকে গোপন করো না, যা তোমরা জানো’। (সুরা বাকারার ৪২ আয়াত) তাই জেনে শুনে সত্য গোপন না করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ যাবৎ সাংবাদিকতার নামে বা যে কোনভাবে সত্য প্রকাশে যারা অবদান রাখছেন বা সত্য উৎঘাটনে কাজ করছেন, তারা প্রকৃতই বিধাতার একনিষ্ট সৈনিক। সুখরঞ্জন বালীও তাদের একজন।
১৭ মে ২০১৩